নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প হলো পোশাক শিল্প। প্রতি বছর পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। করোনা মহামারীর কারণে গত দু’ বছর এই খাতে বেশ মন্দাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে সেই মন্দাবস্থা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে।
পোশাক শিল্পের উত্থান অবশ্য স্বাধীনতার অনেক পরে। স্বাধীনতার পরের বছর মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্যই ছিল পাট ও পাটজাত। পাটের পর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। যদিও মোট রপ্তানিতে এ পণ্য দুটির অবদান ছিল সোয়া শতাংশের কাছাকাছি।
৫০ বছর আগের পণ্য রপ্তানিচিত্রের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চেহারার খোলনলচে বদলে দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। পাটকে হটিয়ে পণ্য রপ্তানির শীর্ষস্থান দখল করেছে পণ্যটি। পাঁচ দশকের ব্যবধানে রপ্তানি আয় ৯৬ গুণ বৃদ্ধি, প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযোগী শিল্পের বিকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে পোশাকশিল্প। চীনের পর একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তৈরি পোশাক খাত বড় বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শক্ত ভীত গড়েছে বিশ্ববাজারে।
বাংলাদেশের পোশাকের বড় গ্রাহক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য বিদায়ী বছরের ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের তৈরি পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে এর পরিমাণ ৭২১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অধীনস্থ অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিইএক্সএ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পোশাকের মধ্যে কটন ট্রাউজার, স্ল্যাকস, নিট শার্ট ও নিট ব্লাউজ উল্লেখযোগ্য। কভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত। এ সময় উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন পোশাক শিল্প মালিকরা। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে বাতিল হতে থাকে একের পর এক ক্রয়াদেশ। উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে রফতানির পরিমাণ। ২০২০ সালের এমন স্তব্ধ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। গত বছরের মে মাস থেকে দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির স্বাভাবিক চিত্র ফিরে আসতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদায়ী বছরের প্রথম ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে অন্তত ৬৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ঢাকা। ২০২০ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০৪ কোটি ডলার। ওটিইএক্সএর দেয়া তথ্য অনুযায়ী গড়ে বিদায়ী বছরের প্রথম ১১ মাসের প্রতি মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে অন্তত ৬০ কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ২০২১ সালের মে থেকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতি মাসেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন ডিসেম্বরের রফতানি প্রবৃদ্ধির অংকও ঊর্ধ্বগামী ধারাতেই থাকবে। সে অনুযায়ী বলা যায় প্রবৃদ্ধির এ হার ৭২১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
পোশাক খাতের শুরুর গল্পটা বেশ চাঞ্চল্যকর। বেসরকারি খাতে ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টসের মাধ্যমে পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করেছিল ফ্রান্সে। সেই চালানে ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্রাঁ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে রিয়াজ উদ্দিনের হাতে গড়া রিয়াজ গার্মেন্টস। সেই থেকে শুরু। তারপর আসে দেশ গার্মেন্টস। সরকারি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নুরুল কাদের খান প্রতিষ্ঠা করেন দেশ গার্মেন্টস। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে পোশাক রপ্তানি শুরু করে। কাজ শেখানোর জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে সে সময় কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন নুরুল কাদের। তাঁদের অনেকেই পরে পোশাক কারখানার মালিক হন।
এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেক্স নামে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন আনিসুর রহমান সিনহা। দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটির কলেবর বাড়তে থাকে। বছর দশকের মধ্যেই ৪৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়। ওপেক্সের কাছাকাছি সময়ে আনিসুল হক, এ কে আজাদ, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, কুতুবউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেকে পোশাকের ব্যবসায় আসেন। সে সময়কার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন পোশাক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি দেশে অন্যান্য খাতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান।
পোশাক খাতকে আজকের এই অবস্থানে আসতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়। কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর পোশাকের খাতে বড় ধাক্কাটি আসে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সেদিন তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা-ে শতাধিক শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেটি সামলে ওঠার আগেই মালিকদের অবহেলায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যান।
পাঁচ মাসের ব্যবধানে বড় দুটি ঘটনায় অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়ে তৈরি পোশাক খাত। দেশে দেশে বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয় শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তীব্র সমালোচনার মুখে বিদেশি ক্রেতা ও শ্রম সংস্থার উদ্যোগে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের উদ্যোক্তারা। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানার কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিসংক্রান্ত ত্রুটি সংস্কার করে বিশ্বে ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হন তাঁরা।
তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকা- ও রানা প্লাজা ধসের পর ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ২০১০-১১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ডলারের। তারপর ৯ বছরের ব্যবধানে সেই রপ্তানি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তবে করোনাকালে নতুন করে সংকটে পড়েছিল খাতটি। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে এখনো। করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সমস্যাও কেটে উঠতে শুরু করেছে। এই খাত আবার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান বাহনের ভূমিকা রাখতে শুরু করবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।