নিজস্ব প্রতিবেদক :
পানির অপর নাম জীবন। তবে এটি শুধু বিশুদ্ধ পানির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পানি যদি দূষিত হয় তাহলে তা জীবন রক্ষার কারণ না হয়ে বরং মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করে দেবে। কাজেই প্রত্যেক মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবারহ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দায়িত্বে নিয়োজিত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলো ওয়াসা। কিন্তু রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির যথাযথ সরবরাহে এই প্রতিষ্ঠান বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। কর্তৃপক্ষের অনিময়, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র এবং অদক্ষতার কারণে ঢাকা ওয়াসা পুরোপুরি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পথে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনিময় ও দুর্নীতির কারণে একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় যেমন বেশি হচ্ছে, তেমনি ঘাটতি মেটাতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে পানির দাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকটের সমাধান চাইলে প্রথমত ওয়াসায় বিদ্যমান দুর্নীতির লাগাম টানতেই হবে। এরপর বিদায় দিতে হবে ওয়াসায় জেঁকে বসা একনায়কতন্ত্র। এ দুটি করা সম্ভব হলে অদক্ষতাসহ বাকি সমস্যাগুলো এমনিতে সমাধান হয়ে যাবে।
এটি স্পষ্ট যে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রাজধানীতে মানুষ কমলেও বেড়েছে পানির ব্যবহার। করোনা মহামারিতে মানুষের দৈনন্দিন সূচিতে পরিবর্তন এসেছে। সব স্তর ও শ্রেণির মানুষ নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। রাজধানীতে স্বাভাবিক সময়ে পানির চাহিদা থাকে ২৪০ থেকে ২৪৫ কোটি লিটার। করোনার কারণে নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। অসংখ্য মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে গেছে। তারপরও রাজধানীতে বর্তমানে পানির চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৪৮ থেকে ২৫০ কোটি লিটার। ওয়াসার টেকনিকাল বিভাগ এরকম দাবি করেছে।
অন্যদিকে, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ওয়াসা বর্তমানে ২৫০ থেকে ২৫২ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। ২৬০ কোটি লিটার পর্যন্ত আমাদের উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।’
দুই তথ্যে দেখা যাচ্ছে বেশ ফারাক। ওয়াসার টেকনিক্যাল বিভাগ আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেওয়া তথ্যে ২ কোটি লিটার পানির হিসাবের গরমিল যার বর্তমান ওয়াসার আবাসিক সংযোগের গ্রাহকদের জন্য নির্ধারিত পানির হাজার লিটারের দাম বাজার মূল্য ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা হলে মাসে হিসেবের গরমিল দাঁড়ায় ৮৬,৭৬,০০০ টাকা।
হিসাবের গরমিল সমাধানে কোন পদক্ষেপ নেই, সরকারের পক্ষ থেকে কোন চাপ নেই অথচ ওয়াসা দফায় দফায় পানির দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন বিগত প্রায় ১৩ বছরে পানির দাম বাড়িয়েছে ১৪ বার। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও দুই বছরে দুদফা আবাসিক ও বাণিজ্যিক পানির দাম বাড়াতে ভুল করেনি সংস্থাটি। তবে প্রতিবছর পানির দাম বাড়লেও ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান বাড়ছে না। সরবরাহ লাইনের পানি সরাসরি খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পানির মান এতোটাই খারাপ যে ফোটালেও এক ধরণের গন্ধ থেকে যায়।
সম্প্রতি পানির দাম আরও এক দফা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে ওয়াসা। জানা যায়, বোর্ড সভায় নতুন করে পানির দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বোর্ড সদস্য প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তবে বেশিরভাগ বোর্ড সদস্য এতে বাদ সাধেন। ফলে প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। এরপরও বোর্ড সদস্যদের ওপর চাপ তৈরি করে তিনি এ প্রস্তাব অনুমোদনের চেষ্টা করছেন।
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস দশা। সয়াবিন তেল হয়ে গেছে রাজার পণ্য। এমতাবস্থায় পানির দাম বৃদ্ধি হবে অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। জানা যায়, নতুন দাম কার্যকর হলে রাজধানীবাসীকে ইউনিট প্রতি আবাসিক পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সার স্থলে ২১ টাকা গুনতে হবে। বাণিজ্যিক পানির দাম ৪২ টাকার স্থলে হবে ৫৫ টাকা। বোর্ড সদস্য সূত্রে জানা যায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের দোহাই দিয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড সদস্যদের এক ধরনের ভয় দেখানো হয়। মূলত এভাবেই ১৪ দফা পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।
ওয়াসাকে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে না পারাটা মূলত ওয়াসার ব্যর্থতা। স্বাধীনতার এত বছর পরও মূলত দুর্নীতির কারণে ওয়াসা সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামানও ওয়াসার দুর্নীতির ব্যাপারে কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ‘ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র এবং অদক্ষতার কারণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো দূর না করে ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ওয়াসায় জেঁকে বসা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ করলে পানির দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। প্রকল্পগুলো অনেক কম টাকায় বাস্তবায়ন করা যেত। একইভাবে প্রকল্পগুলো থেকে কাক্সিক্ষত সুবিধা মিলত। কিন্তু সেদিকে কারও কোনো নজর নেই। ঢাকা ওয়াসাকে স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে গণমানুষের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ বিষয়ে ঢাকাবাসীকে আরও সজাগ হতে হবে। ওয়াসার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। অন্যথায়, জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে স্বৈরতান্ত্রিক চক্রটি।
ওয়াসার এই ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। পানি ছাড়া তাদের কোন উপায়ও নেই। ফলে ওয়াসার এই স্বৈরাচার তাদের সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় নেই। জানা যায়, ঢাকাবাসীর পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা ওয়াসার খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এখান থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছে মাত্র ১৫ কোটি লিটার। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সরবরাহ লাইনের কথা চিন্তাই করেনি ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। তাঁরা যেন সেসময় নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। মূলত এসব কারণে কাক্সিক্ষত সুফল পেতে ব্যর্থ হচ্ছে ওয়াসা।